স্বাধীনতা আন্দোলনের কিছু কথা

স্বাধীনতা আন্দোলনের কিছু কথা

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭) : বাণিজ্যের হাত ধরে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ হয় তাতে বাংলার নবাবের মৃত্যু দিয়ে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। লর্ড ক্লাইভ ইংল্যান্ড দ্বিতীয় বার ফিরে আসেন ১৭৬৫ সালের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। মূলতঃ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল এই প্রায় ১০০ বছর ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার থাকে। এরপর ১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হন। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৭ সালে ভারতে প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন হয়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাত্‍ ১৯৪৫ সালে ভারতবর্ষ জুড়ে ইংরেজ ভারত ছাড় আন্দোলন তীব্রতর হয়।

অগুনতি স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের বলিদানের ফলে ভারত স্বাধীনতা পায় ১৯৪৭ সালে ১৫ই আগস্ট। কিছু বিপ্লবী দের কথা ও ঘটনা বলা হলো যা স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ তাৎপর্য রাখে।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সংঘটিত হয়েছিলো সূর্য সেন-এর নেতৃত্বে। সূর্য সেন ছাড়া এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, শশাঙ্ক দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, অনন্ত সিং, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামক ১৪ বছরের এক বালকও ছিলেন। শুরু হয় ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, রাত দশটায়। পরিকল্পনা ছিল গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা গোলাবারুদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা – এই নামের অধীনে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী এই বিপ্লবে অংশ নেন। সফল বিপ্লবের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হন এবং সেখানে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারী স্যালুট প্রদান করা হয়। সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন। রাত ভোর হবার পূর্বেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন। এক বছর জেলহাজতে অমানুষিক নির্যাতন শেষে ব্রিটিশ সরকার তার ফাঁসির সময় নির্ধারণ করে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলন ক্ষুদিরাম বসুর মতো স্কুলের ছাত্রদেরও প্রভাবিত করে এবং পরিণামে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে সত্যেন বসুর নেতৃত্বে এক গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় পোড়ানো ও ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত লবণ বোঝাই নৌকা ডোবানোর কাজে ক্ষুদিরাম অংশগ্রহণ করেন। স্বদেশি আন্দোলনে সরকারের দমননীতির কারণে কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯০৮ সালে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের ওপর এ দায়িত্ব পড়ে। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ৩০ এপ্রিল মুজাফ্ফরপুরের ইউরোপীয় ক্লাবে কিংসফোর্ডকে আক্রমণের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো অন্য একটি গাড়িতে ভুলবশত বোমা মারলে গাড়ির ভেতরে একজন ইংরেজ মহিলা ও তার মেয়ে মারা যান। ক্ষুদিরাম ওয়ানি রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। মুজফ্ফরপুর কারাগারে ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন ক্ষুদিরাম বসু।

রাসবিহারী বসু, ভারতের যুবসমাজের কাছে উদ্দীপনার সঞ্চারের প্রতীক ছিলেন । বাংলার সুবলদহ গ্রামে জন্ম হয়েছিল তাঁর।ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন বিপ্লবী নেতা এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সংগঠক। ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলায় জড়িয়ে পড়ার পর বাংলা ছাড়েন তিনি। এর পর তিনি দেরাদুনে চলে যান। দেরাদুনে থাকাকালীন রাসবিহারী বোসের সঙ্গে যোগাযোগ হল যুগান্তরের অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁরই হাত ধরে বাঘা যতীনের নেতৃত্বাধীন এক বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়লেন রাসবিহারী বসু। এর পর সন্ত্রাসবাদী বলে তাঁকে সন্দেহ করা হয়। ১৯১৫ সালে ভারত থেকে জাপানে পালিয়ে যান রাসবিহারী বসু। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম রাসবিহারী বোস সুভাষচন্দ্রকে এই ফৌজের কম্যান্ডার করার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে জাপানি নাগরিক হন তিনি, সেখানে বাস করতে থাকেন সাংবাদিক তথা লেখক হিসেবে। জাপানে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি রাসবিহারী বসুর মৃত্যু হয়।

কিশোর বয়স থেকেই যতীন্দ্রনাথের (বাঘা যতীন) মনে পরাধীনতার গ্লানি, দাসত্বের অপমান গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। ১৯০৫ সালে দেশব্যাপী শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিলেন যতীন্দ্রনাথ নিজে। তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করলেন। এইভাবে স্বাধীনতার বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। এই সময় থেকে যতীন্দ্রনাথের অবশিষ্ট জীবন হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রামের ইতিহাস। যতীন্দ্রনাথ ও বারীন্দ্রনাথ ঘোষের অনুরোধেই অরবিন্দ ১৯০৩ সালে কলকাতা আসেন। যোগেন্দ্রনাথের এই বাড়িতেই যতীন্দ্রনাথের সাথে শ্রী অরবিন্দ অবস্থান করতেন। ১৯১০ সালে আলীপুর বোমা হামলা মামলার তদনত্মকারী বিখ্যাত সিআইডি অফিসার মৌলভী শামসুল আলমকে গুলি করে হত্যা করে বীরেন্দ্র দত্ত গুপ্ত নামে এক যুবক। পরে বীরেন্দ্র ধরা পড়লে পুলিশ জানতে পারে এই হত্যাকান্ডের নেপথ্য নায়ক আসলে যতীন্দ্র। ১৯১৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর এই দিন বুড়ী বালামের তীরে মরণজয়ী বিপ্লবীদের রক্তে পরিণত হয়েছিল রক্ততীর্থে। পুলিশ কমিশনার নিকটবর্তী হবার পূর্বেই একটা তপ্ত বুলেট তাঁর কানের পাশ দিয়ে ছুটে গিয়ে বিপ্লবীদের আক্রমণ সংতেক জানিয়ে দিল। গুলি ছুড়েছেন যতীন্দ্রনাথ। এই ভাবে ইংরেজ সৈন্য দের সাথে যুদ্ধে গুলি বিদ্ধ হন এবং মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রীতিলতা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলের প্রথম মহিলা সদস্য হন। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ক্লাব আক্রমণ সফল করেন। এই সময়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হলে তাত্‍ক্ষণিকভাবে পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আত্মদান বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রামে আরো উজ্জীবিত করে তোলে।

সশস্ত্র বিপ্লব : ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিনয়, বাদল, দীনেশ এই তিন বিপ্লবী কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেন এবং কারা বিভাগের অধ্যক্ষ অত্যাচারী সিমসন’কে গুলি করেন। ধরা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে বিনয় নিজ মাথায় গুলি করেন। বাদল ঘটনাস্থলে বিষ খান এবং দীনেশের ফাঁসি হয়।

– তথ্য ও ছবি সংগৃহীত


Sayan Biswas Avatar

About author