জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা

জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা

হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুরী ভীষনভাবে পবিত্র এবং পরিচিত একটি শহর। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই শহর পশ্চিমবঙ্গের পাশ্ববর্তী রাজ্য উড়িষ্যার মধ্যে অবস্থিত । আর এই পুরীতে রয়েছে চারধামের অন্যতম জগন্নাথধাম। চার ধামের মধ্যে পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির অবশ্যই অন্যতম। ঐতিহাসিক এই জগন্নাথ মন্দির ১০৭৮ সালে তৈরি হয়। পরবর্তী কালে বহুবার তা মেরামতি বা পুননির্মাণ এর মধ্যে দিয়ে তা আজকের জগন্নাথ মন্দিরর এর রূপ ধারণ করে। তাইতো পুরীর এখনকার জগন্নাথ দেবের মন্দিরটির সঙ্গে প্রথম তৈরি হওয়া মন্দিরের অনেক তফাৎ। তবে মূল মন্দিরটা তৈরি করেছিলেন রাজা ইন্দ্রদুম্ন । কিন্তু পরে ক্রমে ক্রমে মেঘানন্দ পাচেরি, মুখশালা , নটমণ্ডপ প্রভৃতি আরও বহু কিছু যুক্ত করা হয়েছে এই মন্দিরে। এই পুরীধাম এর ওপর নাম নীলাচল, বা শ্রীক্ষেত্র । জগন্নাথ দেবের পুরীর অন্যতম আকর্ষণ হলো সমুদ্র।সমুদ্রের গর্জন , ঢেউ ,নীল আকাশ ও সমুদ্রের নীল জল সব মিলেমিশে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। তাইতো জগন্নাথ দেব ও সমুদ্রের এর আন্তরিক টানের কাছে হার মেনে মানুষ বার বার ছুটে যায় এই পুরীধামে পরম শান্তি লেভার আশায়। প্রায় সারাবছর ধরেই দেশ বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্তরা জগন্নাথ দেবের দর্শনের জন্য পুরীর এই মন্দিরে এসে ভিড় জমান। এখানে স্বয়ম ভগবানও পরম আনন্দ লাভ করেন ভক্তের সাথে মিলিত হয়ে। তাইতো তিনি বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় স্বয়ম আসেন ভক্ত বৃন্দের মাঝে সকল কে দর্শন দিতে। সেই রকমই একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হলো জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা।

সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা একটি বিশেষ আনন্দের অনুষ্ঠান। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীজগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা পালিত হয়। ভক্তদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। কারণ তারা এই দিনটিকে জগন্নাথ দেবের জন্মতিথি বলে মনে করেন । এই জন্য অসংখ্য ভক্ত স্নানযাত্রা উপলক্ষ্যে পুরীর মন্দির দর্শন করতে যান। স্কন্দপুরাণম্‌-এ বলা হয়েছে, পুরীর মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পরেই প্রথম বার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। স্নানযাত্রার আগের দিন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা, সুদর্শন চক্র ও মদনমোহনের বিগ্রহের একটি বিশাল শোভাযাত্রা মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বার করে স্নানবেদীতে এনে রাখা হয়। ভক্তেরা এই সময় জগন্নাথকে দর্শন করতে আসেন।পুরীতে স্নানযাত্রা উপলক্ষ্যে নীলাকাশের নিচে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সম্মুখে জগন্নাথ, বলরাম, ও সুভদ্রাকে স্নান করানো হয়। ভক্তদের অন্তরের বিশ্বাস, স্নানযাত্রার এই পুন্য দিনে যদি জগন্নাথদেবকে দর্শন করা যায় তাহলে সকল পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

স্নান যাত্রার আগের দিন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দেবী এবং সুদর্শন দেবকে সুন্দর পট্টবস্ত্র দিয়ে ঢেকে বেদী থেকে নামিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি স্নান বেদীতে নিয়ে আসা হয়। পুরীর মন্দির প্রাঙ্গনে তৈরি এই মণ্ডপকে বলা হয় স্নান মণ্ডপ। প্রথমে উত্তর দিকের কূপ থেকে জল এনে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে তার শুদ্ধিকরণ করা হয়। তারপর চন্দন, আতর সহ বিভিন্ন সুগন্ধি দিয়ে ১০৮টি কলসীর পবিত্র জলে বিগ্রহগুলিকে স্নান করানো হয়। সুগন্ধি ধূপ ধুনোর গন্ধে এবং ভক্তবৃন্দের জয়োধ্বনিতে ভোরে ওঠে আকাশ বাতাস। মহা সমারোহে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার স্নান সম্পূর্ণ করা হয়। সেই দিন সন্ধ্যাবেলা স্নানপর্বের সমাপ্তির পর জগন্নাথ দেব ও বলভদ্রকে গণেশের রূপে সাজানোর জন্য হস্তীমুখ-বিশিষ্ট মস্তকাবরণী পরানো হয়। জগন্নাথ দেবের এই রূপটিকে বলা হয় গজবেশ’। প্রচলিত বিশ্বাস, এই স্নানের পরেই জ্বর এসে যায় জগন্নাথ দেবের । এই সময় তাঁকে রাজবৈদ্যের চিকিৎসাধীনে একদম নিরিবিলিতে গোপনে একটি সংরক্ষিত কক্ষে রাখা হয়। এই অসুস্থতার পর্যায়টি অনসর’ নামে পরিচিত। এই সময় শ্রীজগন্নাথদেব এক পক্ষ কাল দৃশ্যমান থাকেন না। ভক্তেরা দেবতার দর্শন পান না। তাঁদের দর্শনের জন্য জগন্নাথ দেবের বিগ্রহের পরিবর্তে মূল মন্দিরে রাখা হয় তিনটি পটচিত্র। জনশ্রুতি এই সময় ভক্তেরা ব্রহ্মগিরিতে অলরনাথ মন্দিরে যান। পুরী থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জনপদ ব্রহ্মগিরি। এখানেই অবস্থিত অলরনাথ মন্দির।তাঁরা বিশ্বাস করেন, অনসর পর্যায়ে জগন্নাথ অলরনাথ রূপে অবস্থান করেন।কথিত আছে, রাজবৈদ্যের আয়ুর্বৈদিক পাঁচন’ খেয়ে এক পক্ষকালের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি । এরপর জগন্নাথদেব নবমূর্তিতে নানা বেশভূষায় সুসজ্জিত হয়ে ভক্তদের পুনরায় দর্শন দেন এবং জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা রাজবেশে সজ্জিত হয়ে মহা সমারোহে রথযাত্রা করে মাসির বাড়ি বেড়াতে যান।

শ্রীক্ষেত্র পুরীতে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে অগুনতি মানুষের ভিড় হয় । শুধু পুরীই নয়, দেশের অন্যান্য প্রান্তে যেখানেই জগন্নাথ দেবের মন্দির রয়েছে সেখানেই জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে মহাসমারোহে পালিত হয় । তবে জগন্নাথদেবের এই তীর্থক্ষেত্র পুরীতে মানুষ আসে প্রধানত জগন্নাথ দেব কে দর্শন করতে কিন্তু সেইসঙ্গে সমুদ্রস্থান, প্রকৃতি দর্শন, ও জগন্নাথ দেবের মন্দির দর্শন করে মানুষ অপূর্ব তৃপ্তি লাভ করে ।জগন্নাথদেবের এই মহিমা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। ভগবান ও ভক্তের এই মিলনক্ষেত্র আজও সমানভাবে বিশ্বব্যাপি মানুষকে আকর্ষণ করে।

-তথ্য সংগৃহীত


Sayan Biswas Avatar

About author