History of Sabarna Roy Choudhury Family and Durga puja
রায় চৌধুরী পরিবারের পুজো
সূত্রানুসারে ১৬০০ সাল থেকেই হালিশহরে দোলমঞ্চের পশ্চিমদিকে একটি আটচালা নির্মাণ করে সেখানেই সপরিবার দুর্গার পুজো শুরু হয়েছিল এই পরিবার। তারপর সেই পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৬১০ সাল থেকে বড়িশার কাছারিবাড়িতে আটচালার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। তৎকালীন সময়ে বড়িশা উন্নত জনপদ ছিল এবং গ্রামে উচ্চবর্ণের হিন্দু, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ মিলেমিশে থাকতেন। তাই মূলত, প্রজাদের মনোরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এক সূত্রে বেঁধে দেওয়ার এক অন্যতম দায়িত্ব পালনের জন্য এমন একটি পুজোর যে বিকল্প নেই সে কথা বিলক্ষণ জানতেন জমিদার লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী। তাই বড়িশার আটচালাতেই লক্ষ্মীকান্ত সপরিবারে মহিষমর্দিনীর আরাধনা শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন সময় সাবর্ণ চৌধুরীদের বাস ছিল হালিশহরে। তাই হালিশহর থেকে বড়িশায় পুজোর সময় আসার জন্য লক্ষ্মীকান্ত একটি রাস্তাও নির্মাণ করেছিলেন। এমনকি জমিদার বাড়ির সদস্যদের যাতায়াতের জন্য হাতি, ঘোড়া, ঘোড়ারগাড়ি এমনকি পালকিও রাখার ব্যবস্থা ছিল।
বড়িশার পাশেই ছিল প্রতাপাদিত্যের কাকা বসন্ত রায়ের রাজধানী সরশুনা। সরশুনাতে এক বিরাট দিঘি থাকার কারণে, সেই স্থান বসন্ত রায়ের নামানুসারে হয় ‘রায়দিঘি’। আর এই রায়দিঘির পাশের গ্রামেই লক্ষ্মীকান্তের আটচালায় ঢাকে কাঠি পড়ত, এ যেন যশোরের রাজবাড়ির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার পরিকল্পনা। এই বংশের দুর্গাপুজো হয় কবি বিদ্যাপতি রচিত পুঁথি ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ মতে। অতীতে বলির জন্য কামার আসত রামচন্দ্রপুর থেকে। সপ্তমীতে ১টি ছাগবলি, মহাষ্টমীতে ২টি ছাগবলি, সন্ধিপূজায় ১টি ছাগ এবং মহানবমীতে ৯টি ছাগ এবং ১টি মহিষ বলিদান হত। তবে বর্তমানে পরিবারে পশুবলিদানের প্রথা বন্ধ হয়েছে, তার পরিবর্তে এই পরিবারে প্রতীকী বলিদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পাড়া দুর্গাপুজো শুরুর সঙ্গেই সাবর্ণপাড়া নামে পরিচিত। এছাড়া বড়িশায় এসে তাঁরা তাঁদের কুলীন জামাইদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, যা কুলীনপাড়া নামে পরিচিত। চিকিৎসকদের বসবাসের জন্য বৈদ্যপাড়ার ব্যবস্থা, পুরোহিতদের বসবাসের জন্য ভট্টাচার্যপাড়া এমনকি নিম্নবর্গীয় মানুষদের বসবাসের জন্য মুচিপাড়া, মাঝিপাড়া, দাসপাড়া, দুলেপাড়া, কুমোরপাড়ার ব্যবস্থা করেন।
বর্তমানে এই পরিবারে আটটি দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। বড়িশায় ছয়টি (আটচালাবাড়ি, বড়বাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝেরবাড়ি, বেনাকীবাড়ি এবং কালিকিঙ্করবাড়ি) এবং বিরাটি রায় চৌধুরী বাড়ি ও নিমতা পাঠানপুর বাড়ি। জন্মাষ্টমীর দিন এই বাড়িতে দেবীর কাঠামোপুজো অনুষ্ঠিত হয় এবং কৃষ্ণানবমী তিথিতে বোধন বসে সাবর্ণদের আটচালায়। এমনকি মহালয়ার পরের দিন বেদি করে পঞ্চঘট স্থাপন করা হয়। আর পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, গণেশ ও শান্তির আরাধনা করা হয়। এই পরিবারে দেবীর গাত্রবর্ণ হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতন এবং একচালার প্রতিমায় ত্রিচালা অর্থাৎ মঠচৌড়ী আকৃতির চালচিত্র থাকে। চালচিত্রে দশমহাবিদ্যা এবং রাধাকৃষ্ণের পট অঙ্কিত থাকে। দেবীর একপাশে থাকেন শ্রীরামচন্দ্র এবং অন্যপাশে থাকেন মহাদেব। তাঁদেরও নিয়মিত পুজো হয় এই পরিবারে। চৌধুরীদের জগত্তারিণী দুর্গার লাল বেনারসী এবং তিনি নানান পারিবারিক অলংকারে সজ্জিত হন। এই পরিবারে গণেশের গায়ের রং হয় লাল এবং অসুরের গায়ের রং সবুজ হয়।
এই পরিবারে অপদেবতাদের সন্তুষ্ট করতে মহাঅষ্টমী ও মহানবমীতে হয় বিশেষ মাসভক্তবলি অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ ১৮০টা খুড়িতে মাসকলাই এবং দই দিয়ে এই পুজো করা হয় অপদেবতা আর উপদেবতাদের সন্তুষ্ট করতে যাতে তাঁরা পুজোয় কোনও বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। এছাড়া এই পরিবারের বড় বাড়িতে সপ্তমীর দিন অর্ধরাত্র বিহিত পুজো ও মহানবমীর দিন কুমারিপুজো হয়। দশমীতে কনকাঞ্জলি দিয়ে জগত্তারিণীকে বিদায় জানানো হয়। আগে কাঁধে করে বিসর্জন হত তবে বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ রয়েছে।
ছবি আর তথ্য : সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের শুভদীপ রায় চৌধুরী