দশমহাবিদ্যা হল দেবী মহামায়ার দশটি বিশেষ রূপ যার উল্লেখ পাওয়া যায় তন্ত্রে। সংস্কৃতে মহাবিদ্যা কথার অর্থ হলো মহৎ জ্ঞান। দশমহাবিদ্যায় দেবীর দশ রূপের একদিকে যেমন রয়েছে ভয়ঙ্করী রূপ,তেমনই অন্যদিকে রয়েছে মোক্ষ ও অভয়দায়িনী রূপ। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ–এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে , শিব ও তাঁর স্ত্রী সতীর মধ্যে একটি দাম্পত্য কলহ থেকেই দশমহাবিদ্যার উৎপত্তি । এই কলহের কারণ হলো ,দক্ষরাজের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা হলেন সতী। সতী ছিলেন দক্ষরাজের নয়নের মণি। কিন্তু একদিন পিতার অমতেই সতী মহাদেব কে পতিরূপে গ্রহণ করেন এবং পিতৃগৃহ ত্যাগ করে কৈলাসে গিয়ে মহাদেবের সাথে ঘর সংসার করতে থাকেন। পিতা দক্ষ, শিব ও সতীর এই বিবাহ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি যখন মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন তখন নববিবাহিত শিব-সতীকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে ত্রিলোকের সকলকে নিমন্ত্রণ করেন । এদিকে পিতার ভবনে বিরাট উৎসবের খবর পেয়ে সতী আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বিনা আমন্ত্রণেই সতী পিতৃগৃহে যেতে চাইলে শিব বারংবার বারণ করেন। দেবাদিদেব মহাদেব বুঝতে পারেন যে সতীর পিতৃগৃহে যাওয়া মঙ্গলজনক হবে না কিন্তু সতী সেকথা বুঝতে চাননা।অনুমতি না পেয়ে সতী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং দেবাদিদেব মহাদেব কে নিজের স্বরূপ দেখতে উদ্যত হন।তিনি তাঁর ক্ষমতা দেখানোর জন্য স্বমূর্তি ত্যাগ করে শিবের ভয় উৎপাদন করার জন্য দশদিকে দশমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে মহাদেবের পথ অবরুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন । আকাশ বাতাস আলোড়িত করে প্রথমে সতী কালী মূর্তি ধারণ করেন। দেবাদিদেব মহাদেব তখন ভীত হয়ে পলায়নের পথ ধারণ করেন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখেন পালাবার কোনো পথ নেই সেখানে দশ দিকে দশটি বিচিত্র দেবীমূর্তি । মহাদেব বুঝতে পারেন স্বয়ম সতী দশটি রূপ ধারণ করে তাঁকে দশ দিক থেকে ঘিরে রেখেছেন। তিনি অনিচ্ছা স্বত্বেও দক্ষগৃহে যাওয়ার অনুমতি দান করেন। সতীর যে দশটি দেবীরূপ শিব দেখেছিলেন সেই দশটি দেবীরূপ দশমহাবিদ্যা রূপে পরিচিত ও আরাধিত হয় । দিব্য জননীর দশটি বিশেষ রূপের সমষ্টিগত নামই হলো দশমহাবিদ্যা আর এই দশটি দেবীমূর্তি মানুষের কল্যাণ করেন ও জ্ঞান দান করেন ,তাই তাঁদের মহাবিদ্যা বলা হয়। কালিকা পুরাণ, দেবী পুরাণ, মৎস্য পূরাণ-সহ বিভিন্ন পূরাণে দশমহাবিদ্যায় দেবীর যে দশটি রূপের উল্লেখ রয়েছে সেগুলি হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনী। এখানে দশমহাবিদ্যার প্রতিটি বিদ্যা বা রূপের সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন
১। কালী:
মহাভাগবতে দশমহাবিদ্যার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে দেবী প্রথম কালী রূপ ধারণ করেছিলেন । কালী হলেন সর্বসংহারকারিনী, জন্ম ও শক্তির দেবী। শুম্ভ ও নিশুম্ভ দুই ভাতৃদ্বয় দীর্ঘদিন তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে দেবতা ও মানবের অবধ্য হওয়ার বর প্রাপ্ত হয়। এই বরে দুজনেই অজেয় হওয়ায় তাদের অত্যাচারে দেবতারা ও মানবকূল অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তখন দেবগণের প্রার্থনায় দেবী দুর্গার ভ্রকুটি থেকে বেরিয়ে আসেন কালী। যার ভয়ঙ্করী রূপ ,সে মুক্তকেশী ,তাঁর গাত্র মেঘবরণ। তিনি লোলজিহ্বা ,তাঁর মুখের দুধারে রক্তধারা। চার হাতের ডান দিকের হাতে খঙ্গ ও চন্দ্রহাস। বাম দিকের হাতে চর্ম ও পাশ। গলায় নরমুণ্ড, দেহ পশু চর্ম আবৃত। বড় বড় দাঁত,কোটরগত আরক্ত চক্ষু ও বিস্তৃত মুখ, স্থুল কর্ণ। তন্ত্রে দেবীর শান্ত ও উগ্র দুই রূপেই বর্ণনা পাওয়া যায় ।
২। তারা:
দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় রূপ হল তারা। দেবী তারা হলেন পথপ্রদর্শক ও রক্ষাকারিনী দেবী। বিশ্বের উৎস হিরণ্যগর্ভের শক্তি এবং মহাশূন্যের প্রতীক। ভীষণ দর্শনা কালীর ভয়ে মহাদেব যখন ভীত হলেন সতী তখন দ্বিতীয় বার আবির্ভূত হন তারা রূপে। তাঁর গায়ের রং নীল, পরিধানে ব্যাঘ্র চর্ম। দেবীর চারটি হাত ও দেবী লম্বোদর । দেবীর অবস্থান প্রজ্জলিত চিতার মধ্যে। তাঁর বাম পা শিবের বুকে অবস্থিত। তন্ত্রশাস্ত্রে ইনি মহানীল সরস্বতী।ত্রিনয়নী দেবীর মাথায় পাঁচটি অর্ধচন্দ্র শোভা পায়। বীরভূম জেলার তারাপীঠে দেবী তারার আরাধনা করা হয়।
৩। ছিন্নমস্তা:
দশমহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ হল ছিন্নমস্তা। দেবীর এই তৃতীয় রূপই সব থেকে ভয়ঙ্কর। এই রূপে দেবী দিগম্বরী ও দ্বিভুজা। দেবী বাম হাতে ধরে আছেন নিজের মাথা এবং গলার কাটা স্থান থেকে তিনটি ভাগে নির্গত হচ্ছে রক্তের ধারা। তিনটি রক্ত ধারার মধ্যে মাঝের ধারা দেবীর সেই ছিন্ন মস্তক পান করছেন।দেবীর বামে সহচরী ডাকিনী ও ডানে সহচরী বর্ণিনী বাকি সেই দুই রক্তধারা পান করছেন। সবাই দিগম্বরী, মুণ্ডমালিনী ও মুক্তকেশী। ছিন্নমস্তা দেবী নানা ফুলে শোভিত। গলায় মুণ্ডমালা এবং নাগ উপবীত। রতি ও কামদেবের উপর ইনি দণ্ডায়মান।চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতার শক্তির প্রতীক এই দেবী মূর্তি ।দেবীর এই বিচিত্র রূপ ধরণের পিছনে নারোদপঞ্চরাত্রি গ্রন্থে যে কাহিনী রয়েছে তা হলো একদিন দেবী পার্বতী ডাকিনী ও বর্ণিনী দুই সহচরী কে নিয়ে মন্দাকিনী নদীতে স্নান করতে যান। মন্দাকিনীতে জলকেলী করে উঠে দুই সহচরী আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদের খাদ্য দাও’। কিন্তু ডাকিনী ও বর্ণিনী রক্ত ও মাংস ছাড়া অন্য খাদ্য খায় না। তখন দেবী অট্টহাস্য করে নিজের নখাগ্র দিয়ে নিজের কণ্ঠচ্ছেদ করলেন। ছিন্নমস্তকটি তখন তাঁর বাম হাতে এসে পড়লো। মুক্তকণ্ঠ থেকে তিনটি ধারায় ফিনকী দিয়ে রক্তস্রোত বের হতে লাগল। দেবীর দুই পাশে দাঁড়িয়ে দুই সহচারী সেই দুই রক্তধারা পান করতে লাগল। মধ্য ধারা দেবী সেই ছিন্ন মস্তক দ্বারা পান করতে লাগলেন। এই রূপ তিনি স্বামীকে ভয় দেখানোর জন্য ধারণ করেছিলেন ।
৪। ষোড়শী:
দশমহাবিদ্যার চতুর্থ রূপ হলো ষোড়শী। দেবীর রাজরাজেস্বরী রূপ। দেবীর এই রূপ ধারণের এক পৃথক কাহিনী সোনা যায়। শিব ও পার্বতীর এক দাম্পত্য কলহের ফলে দেবী ক্রোধান্বিত হয়ে নিজ রূপ পরিবর্তন করে ষোড়শবর্ষীয়া এক অপূর্ব সুন্দরী নারী হয়ে ওঠেন। দুর্গার অন্য রূপ শতাক্ষীর দেহ থেকে তিনি আবির্ভূত হন ষোড়শী রূপে। ষোড়শীর অপর নাম স্ত্রী বিদ্যা। তাঁকে ত্রিপুরা সুন্দরী, রাজ রাজেশ্বরী বলা হয়ে থাকে । ত্রিপুর শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যিনি ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষম্নাতে অথবা মন, চিত্ত ও বুদ্ধিতে অবস্থিত। দেবী ষোড়শী তান্ত্রিক পার্বতী নামেও পরিচিতা। দেবীর চার হাত, গায়ের রং জবাকুসুমের মতো অর্থাৎ ভোরের সূর্যের মতো,তিনি ত্রিনয়নী ,তাঁর হাতে নানাবিধ অস্ত্র। তাঁর কপালেও শোভা পাচ্ছেন সুধাকর। মহাদেবের নাভি পদ্মের উপর দেবী আসীন। দেবীর আসনের নীচে দেবগণ কে স্তব স্তুতি করতে দেখা যায় । আচার্য শঙ্করাচার্য ও অভিনব গুপ্ত কর্তৃক এই দেবী পূজিতা হয়েছিলেন। দেবী ষোড়শী পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতার স্বরূপ।তিনি শ্রীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী।
৫। ভুবনেশ্বরী:
দশমহাবিদ্যার পঞ্চম রূপ ভুবনেশ্বরী। তিনি সমস্ত ভুবনের ঈশ্বরী বলে তাঁকে ভুবনেশ্বরী নামে চিহ্নিত করা হয়। তন্ত্র শাস্ত্রে জানা যায়, মহাদেবের উপর অভিমান ও রাগে দেবী ষোড়শী রূপ ধারণ করেন কিন্তু তিনি নিজের রূপ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তাই শিবের বক্ষে নিজের এই নতুন রূপের ছায়া দেখে অন্য কোনো নারী মনেকরে নিজেই ভীত হয়ে পড়েন । পরে সেই ছায়া নিজের জেনে স্থির হন। দেবীর এই সুস্থির রূপ ভুবনেশ্বরী রূপে চিত্রিত হয়েছে। এই দেবীর গায়ের রং জবা ফুলের মতো ,তিনি সুভূষণা এবং নানাবিধ অলংকারে তিনি সর্বদা ঝলমল করেন । তাঁর চার হাতে অস্ত্র ও বরাভয় মুদ্রা। তিনি পদ্মের উপরে উপবিষ্টা। তাঁর চার দিকে চার জন দেবী এই দেবীকে ঘিরে আছেন। দেবীর আরও সহচরী আছে।দেবী পার্থিব জগতের শক্তিসমূহের প্রতীক।
৬। ভৈরবী:
দশমহাবিদ্যার ষষ্ঠ রূপ দেবী ভৈরবী। দেবী রক্তবর্ণ ,তাঁর গলদেশে শোভা পায় মুণ্ডমালা। ইনি চতুর্ভুজা, তাঁর চারটি হাতে জপমালা,পুস্তক ,অভয়মুদ্রা,ও বরমুদ্রা বিদ্যমান । দেবী অস্ত্রহীন। তাঁর তিনটি চোখ রক্তপদ্মের মতো।,কপালে শশিকলা। এই দেবী বিদ্যা ও ধনদাত্রী। চৌষট্টি যোগিনীদের মধ্যে প্রধানের নাম ভৈরবী।দেবী সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নামে পরিচিত।দেবী ভৈরবী কোনো কোনো স্থানে চামুন্ডা নামেও পরিচিত।
৭। ধূমাবতী:
দশমহাবিদ্যার সপ্তম রূপ দেবী ধূমাবতী। এটি দেবীর বিধবা দেবীমূর্তি।এই রূপ গ্রহণের কাহিনীও বিচিত্র। একদিন কৈলাশে পার্বতী প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর হয়ে বারবার শিবের কাছে অন্ন চান। কিন্তু শিব তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন ।ক্ষুধাতুর পার্বতীকে দেখেও শিবের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য দেখা দেয় না। দেবী ধৈর্যচ্যুত হয়ে ক্ষুধার জ্বালায় ক্ষিপ্ত হয়ে শিবকে গ্রাস করে ফেলেন । সঙ্গে সঙ্গে দেবীর দেহ থেকে ভীষণ ধোঁয়া নির্গত হতে থাকে। সেই ধোঁয়া দেবী পার্বতীকে বিবর্ণ করে দেয়। ধোঁয়ার আবৃত দেহ থেকে শিব বের হয়ে নিজমূর্তি ধারণ করে বলেন, ‘তুমি যখন ক্ষুধায় আমাকে গ্রাস করেছ তখন তুমি বিধবা হয়েছ। এই বিধবা বেশে তুমি ধূমাবতীরূপে পূজিতা হবে।” তাই দেবী ধূমাবতী বিধবা,শিবহীন, ভয়ঙ্করী, রুক্ষ মলিন বসনা, বিবর্ণ কুণ্ডলা, বিরল দন্তা, নিত্য বুবুক্ষিতা, অতিকৃশা, বৃদ্ধা। ধূমাবতীর দুই হাত, একহাতে কুলা ও অন্য হাতে ধর। ইনি রথরূঢ়া। রথের ধ্বজ চারটিতে চারটি কাক।তিনি কখনও কখনও অলক্ষ্মী বা জ্যেষ্ঠাদেবী নামেও অভিহিতা হন। আবার তন্ত্রে বলা হয়ে থাকে সতীর দেহত্যাগ এর পরে তাঁর দেহ থেকে মহাধূমরাশি নির্গত হয়েছিল। সেইজন্য দেবী ধূমাবতী নামে খ্যাত হয়েছিলেন।
৮। বগলা:
দশমহাবিদ্যার অষ্টম রূপ বগলা। দেবী বগলা কে শত্রুনিষ্ক্রিয়কারিনী দেবী বলা হয়ে থাকে।এই রূপে দেবী সুধা সমুদ্রের মাঝে রক্ত সিংহাসনের উপরে উপবিষ্টা। দেবী পীতবর্ণা। তিনি পীতবস্ত্র পরিধান করেন।চন্দ্র ,সূর্য ও অগ্নি তাঁর ত্রি নয়ন। দেবীর কপালে অর্ধ চন্দ্র। তন্ত্রে বর্ণিত কাহিনী থেকে জানা যায় ,রুরু নামক দৈত্যের পুত্র দুর্গম দেবতাদের চেয়ে বলশালী হওয়ার জন্য ব্রহ্মার তপস্যা করে বরপ্রাপ্ত হন। দেবতারা তখন দেবী ভগবতীর আরধনা করেন। দেবী আর্বির্ভূত হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই দেবী সিংহাসনে উপবিষ্টা। দ্বিভূজ দেবী বাম হাতে দুর্গম অসুরের জিহবা ধরে ডান হাতে গদা দিয়ে শত্রূ দমন করেন। ঈর্ষা, ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার মতো মানবচরিত্রের অন্ধকার দিক নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি । দেবী বগলার আরাধনা করলে মানুষ সর্ব বিদ্যা লাভ করে।
৯। মাতঙ্গী:
দশমহাবিদ্যার নবম রূপ হল মাতঙ্গী। দেবী মাতঙ্গীকে বলা হয় কর্তৃত্ব শক্তির দেবী।দেবী শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়না, চতর্ভূজা ও রক্ত পদ্মের উপরে উপবিষ্টা। রক্ত বসন পরিধান করেছেন। দেবীর সন্তান হাতি। মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে দেবতারা আরাধনায় ইনি মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর শরীর থেকে বের হয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভ দৈত্যদের বধ করেন। তন্ত্র মতে মহাদেবের ভজনা করার জন্য দেবী চণ্ডাল বেশ ধারণ করেন। তাঁর এরূপ সাধনায় তৃপ্ত হয়ে মহাদেব তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেন “তোমার এই রূপ পূজা হবে ,এই রূপের নাম হবে মাতঙ্গী। সকল পূজার শেষে এই রূপের পূজা করলে মানুষ সিদ্ধিলাভ করবে
১০। কমলা:
দশমহাবিদ্যার শেষ বা দশম রূপ ঐশ্বর্য লক্ষ্মী কমলা। কমলারুপী দেবী মহালক্ষ্মী। দেবীর গাত্রবর্ণ সোনার মতো। দেবী কমলার উৎপত্তি দেবতা ও অসুর দের সমুদ্র মন্থনের সময়। দেবী চতুর্ভূজা। দেবীর দুই ডান হাতে পারিজাত পুষ্প, বাম দিকে উপর হাতে বরমুদ্রা।সমুদ্রের মধ্যে দেবী প্রস্ফুটিত পদ্মে আসীন। আবার তিনি চণ্ডীর একরূপ কমলে কামিনী। দেবী কমলা ঐশ্বর্যময়ী ,মর্তবাসীর ঘরে ঘরে তিনি সম্পদের দেবী রূপে পূজিতা। তিনি বরাভয় প্রদায়িনী শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী। ভাগ্যদেবী লক্ষ্মীর আরেক রূপ। তিনি তান্ত্রিক লক্ষ্মী নামেও অভিহিতা।
দেবীত্বের এই ক্রমবিন্যাসের একদিকে যেমন রয়েছেন ভয়ংকর দেবীমূর্তি, তেমনই অন্য প্রান্তে রয়েছেন এক অপরূপ সুন্দরী দেবীপ্রতিমা। এই ভাবে দশটি মূর্তিতে কখনও তিনি বিচিত্র রূপ ধারণ করে ভয় দেখিয়েছেন , আবার কখনও শান্ত সৌম্য মূর্তিতে মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে পিতৃগৃহে যাত্রা করার অনুমতি আদায় করে নিয়েছেন । মহাদেবের বরে এই দশটি মূর্তিই দশমহাবিদ্যা হিসাবে পূজিতা হন।শাক্তধর্মের ইতিহাসে দেবীর দশমহাবিদ্যা শাক্তধর্মে ভক্তিবাদের সূচনা ঘটায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যা লাভ করে চূড়ান্ত সমৃদ্ধি।এই ধর্মমতে পরম সত্ত্বাকে নারীরূপে কল্পনা করা হয়। এই মতকে ভিত্তি করে একাধিক ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো দেবীভাগবত পুরাণ। শাক্তরা বিশ্বাস করেন, একই সত্য দশটি ভিন্ন রূপে প্রকাশিত; দিব্য জননী দশটি বিশ্বরূপে দৃষ্ট ও পূজিত হয়ে থাকেন।” এই দশটি রূপই হল দশমহাবিদ্যা।
দশমহাবিদ্যা ও নবগ্রহের নিবিড় সম্পর্ক ,যা এই জগৎ সংসার কে চালনা করেচলেছে প্রতিনিয়ত। এখানে দেখে নেওয়া যাক কোন গ্রহে দেবী কি রূপে অধিষ্ঠান করছেন। যেমন শনিগ্রহের ইষ্টদেবী কালীকা,বৃহস্পতির ইষ্টদেবী তারা ,বুধগ্রহের ইষ্টদেবী ষোড়শী ,চন্দ্রের ইষ্টদেবী ভুবনেশ্বরী , দেবী ভৈরবী সময় ও লগ্নের নিয়ন্ত্রণ করে ,রাহুগ্রহের ইষ্টদেবী প্রচণ্ড চন্ডিকা ছিন্নমস্তা,কেতুগ্রহের ইষ্টদেবী ধূমাবতী,মঙ্গলগ্রহের ইষ্টদেবী বগলামুখী,সূর্যগ্রহের ইষ্টদেবী মাতঙ্গী এবং শুক্রগ্রহের ইষ্টদেবী কমলা।
দশমহাবিদ্যার দেবীর পৃথক পৃথক রূপের সাথে পৃথক পৃথক নামে ভৈরবও বিরাজ করছেন । তাইতো দেবীদের পূজার সময় তাঁদের ভৈরবদেরও পূজা করতে হয়। সর্বদা দেবীমূর্তির ডান দিকে তিনি বিরাজমান। দেবী কালিকার ভৈরব হলেন মহাকাল। দেবী তারার ভৈরব হলেন অক্ষোভ্য। দেবী ছিন্নমস্তার ভৈরবের নাম কবন্ধশিব। দেবী ষোড়শীর ভৈরব হলেন পঞ্চাননশিব। দেবী ভুবনেশ্বরীর ত্র্যম্বক। দেবী ভৈরবীর ভৈরব দক্ষিণামূর্তি। দেবী বগলামুখীর ভৈরবের নাম একবক্ত্র মহারুদ্র। দেবী মাতঙ্গীর ভৈরব মতঙ্গশিব আর দেবী কমলার ভৈরব হলেন বিষ্ণুরূপী সদাশিব।
তবে এই দশমহাবিদ্যামূর্তির একত্র পূজা সাধারণত হয় না। আলাদা আলাদা করে বিশেষ পর্বে পূজা হয় বিভিন্ন দেবীমূর্তির। বিভিন্ন দেবীমূর্তির পূজার নিয়ম ও উপাচারও বিভিন্ন রকমের। তবে কালীপূজা ও দেবী কমলার পূজার চলই বেশী গৃহস্থ বাড়িতে।তন্ত্রমতে এই দশটি রূপ হলো দশ প্রকারের তন্ত্রবিদ্যা। যা জগৎ, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আন্তসম্পর্কে আবর্তিত। শাক্তরা বিশ্বাস করেন , একই সত্য দশটি ভিন্ন রূপে প্রকাশিত ; দিব্য জননী দশটি বিশ্বরূপে দৃষ্ট ও পূজিত হয়ে থাকেন ।” এই দশটি রূপই হল দশমহাবিদ্যা ।দশমহাবিদ্যার দশটি রূপের মধ্যে দিয়ে আমরা যেন দেবীকে আরো কাছের করে পেয়েছি। সে তাঁর দেবত্বকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছেন আমাদের ঘরের মেয়ে উমা। যে কিনা পিতৃগৃহে যাওয়ার জন্য মান অভিমান করে যে ভাবেই হোক স্বামীর অনুমতি আদায় করে। তাইতো শারদোৎসবের সময় আমরা দশভুজা মহামায়া কে নিজের ঘরের মেয়ে রূপে সমাদ।
তথ্য সংগৃহীত লেখা সুস্মিতা বিশ্বাস
-ছবি সায়ান বিশ্বাস