ভারতের পুরাণ ও মহাকাব্যের এক উল্লেখযোগ্য ঋষি চরিত্র হলো মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। তার নামের প্রতিটি শব্দই অর্থময়।তিনি যমুনা নদীর একটি দ্বীপে জন্মেছিলেন বলেই তাঁর প্রথম নাম হয় দ্বৈপায়ন। দ্বৈপায়ন এর গায়ের রং ছিলো কালো, তাই তাঁর ডাক নাম হয় কৃষ্ণ এবং পুরো নাম হয় ‘কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন’। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে, বেদের মন্ত্রগুলোকে সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করার সময় বিষয় অনুযায়ী বেদকে চারটি ভাগে ভাগ করেন ব’লে তার আরেক নাম হয় বেদব্যাস যা পরবর্তী কালে রূপ নেয় ‘ব্যাসদেব’ এ। এভাবে এই মহাঋষির পূর্ণ নাম হয়ে ওঠে ‘শ্রী কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস’ বা সংক্ষেপে ‘ব্যাসদেব’। ব্যাসদেব এর চোখ ছিল উজ্জ্বল ও মুখে ছিলো পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি ,মাথায় ছিলো জটা । তাঁর তপস্যার স্থান ছিলো বদরিকাশ্রম , তাই তাঁকে বাদরায়ণ বলা হয়। । বেদের বহু মন্ত্রের রচয়িতা এবং বহু শাস্ত্রের জনক ঋষি পরাশর ছিলেন দ্বৈপায়ন ব্যাসের পিতা ।পরাশর ছিলেন শক্তির পুত্র, শক্তি ছিলেন মুনি বশিষ্ঠের পুত্র।তাঁর মাতার নাম সত্যবতী।ব্যাসদেব- চারটি বেদ, ১৮ টি পুরান, উপপুরান, বেদান্ত দর্শন, ভাগবত পুরান প্রভূতি সংগ্রহ করে সংকলন করেন এবং মহাভারত রচনা করেন। তিনি মহাভারতের সময় সাত পুরুষ ধরে জীবিত ছিলেন। একই সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাসের মধো ।</p>
পুরাণের বর্ণনা অনুসারে যখন সত্যবতী যমুনা নদীতে ঋষি পরাশরকে খেয়া পার করছিলেন তখন সেই সময় পরাশর মুনি তার দিব্যজ্ঞানে বুঝতে পারেন, একমাত্র সত্যবতী ই তাকে তার উপযুক্ত পুত্র দিতে পারে। পরাশরমুনি সত্যবতীকে প্রস্তাব দেয়, তাকে একটি পুত্র দেওয়ার জন্য।কিন্তু সত্যবতী জানান তিনি কুমারী। পুত্র দিতে গিয়ে যদি তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়, তাহলে লোকে তার নামে কটূ কথা বলবে। শুনে পরাশর মুনি জানান তাকে পুত্র দানের পর সত্যবতী কুমারীই থাকবে এবং ভবিষ্যতে তার বিবাহ হবে রাজপরিবারে।কিন্তু সেসময় সত্যবতীর দেহ থেকে সর্বক্ষণ মৎস গন্ধ বেরোতো। তাই তার নাম ছিল মৎসাগন্ধা। এক যোজন দূর থেকে এই গন্ধ পাওয়া যেত বলে, যোজনগন্ধা বলেও সত্যবতী পরিচিত ছিলেন।এইসময় পরাশর মুনির বরে সত্যবতীর দেহের মৎস্যগন্ধ পরিণত হয় পদ্মগন্ধে। এই কারণে তার আর এক নাম হয় পদ্মগন্ধা।এরপর পরাশর মুনির কথাকে বিশ্বাস করে, তার ইচ্ছাকে পূরণ করতে সত্যবতী নদীর মধ্যবর্তী দ্বীপে গর্ভবতী হয়ে সেই দিনই একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে। সেই পুত্র প্রসব হওয়া মাত্রই বালকের মতো হাঁটতে শুরু করে এবং মায়ের অনুমতি নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আশ্রমে চলে যায়।
পরবর্তী কালে সত্যবতীর রূপে গুনে মুগ্ধ হয়ে হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু তাকে বিবাহ করেন ও রাজপরিবারে নিয়ে যান।রাজগৃহে তার চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্র হয়। কিন্তু দুর্ভাগাক্রমে দুজনেই যুবা বয়সে মারা যান। দুই পুত্রের অকাল মৃত্যুতে হস্তিনাপুরের ভবিষাৎ চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন সত্যবতী।তখন তিনি শান্তনু ও গঙ্গার পুত্র ভীম্মের সঙ্গে পরামর্শ করে তার পুত্রব্যাসদেবকে স্মরণ করেন।মাতার আহ্বানে ব্যাসদেব উপস্থিত হন এবং মাতার অনুরোধে তৎকালীন সামাজিক ও ধর্মসম্মত রীতি অনুযায়ী বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী অশ্বিকা ও অন্বালিকার গর্ভে পরবর্তী বংশ প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখেন ।এই সময় থেকেই ব্যাসদেব বিশাল মহাভারত কাহিনীর প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন।তার আশীর্বাদেই গান্ধারীর শতপুত্রের জন্ম সম্ভব হয়েছিল। তার উপদেশেই প্রসৃত মাংসখগুটিকে একশত একটি টুকরো করে গান্ধারী শতপুত্র ও একটি কন্যার জননী হতে পেরেছিলেন। কন্যার নাম দেওয়া হয়েছিল দুঃশলা। একদিন যখন ব্যাসদেব সরস্বতী নদীর তীরে আশ্রমে , তপস্যা করছিলেন তখন দেখতে পেলেন একটি চড়াই পাখি তার দুই ছোট্ট শাবককে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। এই দৃশা দেখে ব্যাসদেবের মনে অপত্যস্নেহ জাগরিত হয়।তখন দেবর্ষি নারদ অপ্সরা ঘৃতাটীর সঙ্গে তার বিবাহ স্থির করেন ।কালক্রমে অপ্সরা ঘৃতাটীর গর্ভে ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব জন্মলাভ করেন ।মহাভারতের প্রতিটি সঙ্কটময় মুহূর্তে ত্রাতার ভূমিকায় মহর্ষি ব্যাসদেবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পান্ডবদের সঙ্গে পাঞ্চালী দ্রৌপদীর বিবাহ নিয়ে সঙ্কট উপস্থিত হলে ব্যাসদেব উপস্থিত হয়ে সময়ানুগ উপদেশ দেন। আবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে ব্যাসদেব একদিন রাজসভায় উপস্থিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্যদৃষ্টি দান করতে চান,যাতে তিনি এই ধর্ম অধর্মের যুদ্ধ নিজচোখে দেখতে পান।
কিন্তু দৃষ্টিহীন এবং পুত্রস্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রই ছিলেন অধর্মের পালক তাই তিনি এই ধর্মযুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে ভীত হয়ে দিব্যদৃষ্টি গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন এবং সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টি দান করার অনুরোধ করেন। সেই দৃষ্টিবলেই সঞ্জয় আঠারো দিনের কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের বিবরণ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়েছিলেন।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শতপুত্রের মৃত্যু হলে শোকাতুরা গান্ধারী অভিশাপ দিয়ে পান্ডবদের ধ্বংস করার সংকল্প করলে ব্যাসদেবই তাকে এই সর্বনাশা কর্ম থেকে নিরস্ত করেন।যুদ্ধশেষে তিনি গান্ধারীকে সান্ত্বনা প্রদান করেন। এইভাবে মহাভারতের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য নাটকীয় মুহূর্তে ব্যাসদেবের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। যদিও কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ নিবারণের বহু চেষ্টা তিনি করেছিলেন কিন্তু বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের মতো তিনিও সেই মহারণ নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হন।
<p>বদরিকাশ্রমের কুটিরে বসবাসের সময় একদিন অকস্মাৎ সেখানে উপস্থিত হন ব্রহ্মা। ব্যাসদেব তাঁর আগমনের কারণ জানতে চাইলে ব্রহ্মা বলেন , তাঁকে মহাভারতের কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে। কারণ তিনি মহাভারতের যুদ্ধের সাক্ষী। এই যুদ্ধের দুই পক্ষই তাঁর আপনজন। তখন ব্যাসদেব তাঁকে জানান এই বিরাট কাজ তাঁর একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই তাঁর চাই একজন সহকারী যিনি শুনে শুনে ওই কাহিনি লিপিবদ্ধ করবেন। ব্রহ্মা ব্যাসদেব কে গণেশের নাম লিপিকার হিসাবে প্রস্তাব করেন । গণেশ তখন এক শর্তে সম্মত হয়েছিলেন । শর্ত হলো তাঁর লেখনী এক মুহূর্তের জন্যও থামবে না, ব্যাসদেবকে টানা বলে যেতে হবে।তখন ব্যাসদেব একটু চিন্তা করে জানালেন, তিনি যা বলে যাবেন তার অর্থ না বুঝে গণেশও লিখতে পারবেন না। গণেশ সেই শর্তে সম্মত হলেন। ব্যাসদেব যখন একটি কঠিন শ্লোক বলতেন গণেশ তার অর্থ নিয়ে ভাবতেন, আর সেই সুযোগে ব্যাসদেব অন্যান্য শ্লোক রচনা করে নিতেন। এইভাবে সম্পূর্ণ মহাভারত রচনা করতে প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। তবে ওই কঠিন শ্লোকগুলিকে বলা হয় ব্যাসকূট যার অর্থ জানেন স্বয়ং ব্যাসদেব, পুত্র শুকদেব। তবে মহাভারত লেখার সময় জেনে নিয়েছিলেন গণেশ। মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব ব্যাসকূট বা দুরূহ শ্লোক বুঝতে পারেন বলে যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁরা হলেন ব্যাস, শুক, সঞ্জয় ও গণেশ—প্রত্যেকেই সমদর্শী অর্থাৎ দুই পক্ষ সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত। ব্যাস হলেন কেন্দ্র-প্রান্তের উভমুখী যোজক। শুকের দুটি পক্ষ বা ডানা আছে। ‘সঞ্জয়’ শব্দের মূলীভূত ধাতু ‘সম্’ হল সমতা বা তুল্যার্থ। শাস্ত্রে গণেশ হলেন দ্বিদেহক। ফলে কূট বোঝার পক্ষে তাঁরাই উপযুক্ত লোক। ব্যাসের মহাভারত একমুখী সন্দর্ভ নয়, তা বহুমুখী ও গভীর। ব্যাসদেব প্রথমে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের জয় সূচক উপাখ্যান যুক্ত ১০০০০০ শ্লোক সমন্বিত আদ্য জয় গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বশেষে তিনি ষাট লক্ষ শ্লোক সমন্বিত অপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেই গ্রন্থের ৩০ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, ১৫ লক্ষ শ্লোক পিতৃলোকে, ১৪ লক্ষ রক্ষোযক্ষ লোকে স্থান পেয়েছে এবং অবশিষ্ট মাত্র ১ লক্ষ শ্লোক এই মনুষ্যলোকে ‘মহাভারত’ নামে সমাদৃত হয়েছে।তারপর মহাভারত রচনা সম্পূর্ণ হলে ব্যাসদেব এই কাব্য তাঁর পুত্র শুকদেবকে দিয়ে অধ্যয়ন করান। পরে শিষ্য পরম্পরায় গ্রন্থটি বৈশম্পায়ন, পৈল, জৈমিনি, অসিত-দেবল প্রভৃতি ঋষি দ্বারা পঠিত হয়। শুকদেব এই গ্রন্থটির কাহিনি গন্ধর্ব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে, দেবর্ষি নারদ দেবতাদের মধ্যে ও অসিত-দেবল পিতৃদের মধ্যে প্রচারিত করেন।বৈশম্পায়ন এই কাহিনিটি প্রথমে মনুষ্যদের মধ্যে ‘ভারত’ নামে প্রচার করেন।অর্জুনের প্রপৌত্র মহারাজ জন্মেজয়ের মহাযজ্ঞে ঋষি বৈশম্পায়ন ওই কাহিনি জন্মেজয় সহ সৌতি এবং উপস্থিত মুনি-ঋষিদের শোনান। বস্তুত সর্ব অঙ্গ ও প্রাণ নিয়ে সমগ্র ভারতবষই বিবৃত হয়েছে মহাভারত এর এই কাহিনীতে। মহাকাব্য মহাভারত রচনা ছাড়াও, সমগ্র বেদকে ঝক, সাম, যজু, অথর্ব এই চারভাগে ভাগ করেছিলেন ব্যাসদেব। মহাভারতকে বলা হয়ে থাকে পঞ্চমবেদ।বেদাস্তের রচয়িতাও ব্যাসদেব।এভাবেই মহাভারতসহ নানান পুরান রচনা করেন ব্যাসদেব। ঋষি পরাশর পুত্র মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে আজও অমর হয়ে আছেন।সরস্বতী নদীর তীরে নিজ সাধনভূমি বদরিকাশ্রমে সমাধি অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন ব্যাসদেব।ভারতীয় ধর্মীয় জীবনে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব গুরু রূপে পুজিত । এই কারণে আজও তার জন্মতিথি শ্রাবণী পূর্ণিমাকে গুরুপূর্ণিমা রূপে পালন করা হয়।