ইতিহাসের লক্ষ-কোটি নৃপতির মধ্যে মৌর্য সম্রাট অশোক এর নামটি একাকী একটি নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বল করছে। কারণ মৌর্য সম্রাট অশোক কেবল ভারতবর্ষের ইতিহাসেই নয়,তাঁর মহানুভবতার জন্য তিনি বিশ্বের ইতিহাসেও এক অনন্য স্থান লাভ করেছেন ।মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র ,নৃপতি বিন্দুসারের পুত্র অশোক সমৃদ্ধ মৌর্য রাজবংশের তৃতীয় শাসক ছিলেন এবং প্রাচীন যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজাদের মধ্যে তিনি একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম পূর্ব ভারতীয় শাসক যিনি উপমহাদেশের বৃহত্তর অংশে তাঁর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।
ইতিহাস প্রসিদ্ধ মহামতি অশোক খ্রীষ্টপূর্ব ২৭২থেকে ২৯৮ অব্দ পর্যন্ত ভারত শাসন করেছিলেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিন্দুসার তাঁর জ্ঞান ও দক্ষতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁকে উজ্জ্বয়িনীর শাসনকর্তা নিয়োগ করেছিলেন । তারপর তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, তক্ষশীলায় বিদ্রোহ শুরু হলে বিন্দুসার বিদ্রোহ দমনের জন্যও তাঁকে তক্ষশীলায় পাঠিয়েছিলেন । কিন্তু এই সময় বিন্দুসারের অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের দখল নিয়ে রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব শুরু হয়েযায় । তখন অশোক অন্যান্য ভাইদের পরাজিত ও হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিলেন। তিনি রাজা হওয়ার পরই সাম্রাজ্য বিস্তারে মনযোগী হন। তিনি পূর্বে বর্তমান আসাম ও বাংলাদেশ, পশ্চিমে ইরান ও আফগানিস্হান, উত্তরে পামীর গ্রন্থি থেকে প্রায় সমগ্র দক্ষিণভারত নিজের সাম্রাজ্যভূক্ত করেন। এরপর অশোক কলিঙ্গ প্রজাতন্ত্র দখলে উদ্যোগী হন । রাজ্যাভিশেখের আট বছর পরে সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে ব্যাপৃত হন।
সম্রাট অশোক এর জীবনের সর্বপ্রধান ঘটনা ছিল এই কলিঙ্গ যুদ্ধ। প্রতিবেশী দুই সাম্রাজ্য ছিল মগধ এবং কলিঙ্গ। মগধ অপেক্ষাকৃত বড়, তার শক্তিও তুলনায় বেশি। তবুও মগধ সম্রাটের মনে শান্তি ছিল না । প্রতিবেশী এক শত্রুকে রেখে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়! দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীও শক্তিশালী। কিন্তু মগধের সৈন্যরা অনেক বেশি যুদ্ধপটু আর কৌশলী। কলিঙ্গের সৈন্যরা বীরবীক্রমে লড়াই করেও পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় । আহত আর নিহত সৈন্যে ভরে ওঠে যুদ্ধক্ষেত্র। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে সমস্ত প্রান্তর। কলিঙ্গরাজ নিহত হন । বিজয়ী মগধ সম্রাট হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন তার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অসংখ্য মৃতদেহ। কত আহত সৈনিক। কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করছে। কেউ সামান্য একটু জলের জন্য ছটফট করছে। আকাশে মাংসের লোভে শকুনের দল ভিড় করছে। যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সম্রাট এর মন বিষণ্ণতায় ভোরে ওঠে । অনুভব করলেন তার সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে নিজের তাঁবুতে ফিরে দেখলেন শিবিরের সামনে দিয়ে চলেছে এক তরুণ ভিক্ষুক । ভিক্ষুক বললেন, “আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের সেবা করতে চলেছি। মুহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সম্রাটের হৃদয়। সম্রাটের অন্তরে জ্বলে উঠল নতুন এক প্রজ্ঞার আলোক। তিনি শপথ করলেন আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, ভগবান বুদ্ধের করুণায় আলোয় অহিংসা মন্ত্রে ভরিয়ে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবী।তিনি বৌদ্ধ পণ্ডিত উপগুপ্তের কাছে বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষা নিলেন। একদিন যিনি ছিলেন উন্মত্ত দানব-এবার হলেন শান্তি আর অহিংসার পূজারি প্রিয়দর্শী অশোক।কলিঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্য ভুক্ত হলেও সম্রাট অশোকের জীবনে ও নীতিতে চলে আসে আমূল পরিবর্তন।এরপর থেকে সম্রাট অশোক পররাজ্য গ্রহণ নীতি& পরিত্যাগ করেন এবং এর পরিবর্তে সাম্য ,মৈত্রী ,সামাজিক অগ্রগতি ও ধর্ম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করেন।তিনি ঘোষনা করলেন আমার পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র কেউই আর ভবিষ্যতে অস্ত্র ধারন করবে না।” বৌদ্ধ ধর্মের প্রেম করুণায় পূর্ণ হয়ে উঠল তার হৃদয়। চণ্ডাশোক অশোক রূপান্তরিত হলেন ধর্মাশোক অশোকে। তিনি ঘোষণা করলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার হবে ধর্ম বিজয়। ভ্রাতৃত্ব প্রেম, করুণার মধ্যে দিয়ে অপরকে জয় করতে হবে। শুধুমাত্র নির্দেশ প্রদান করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন না। এত দিন যে রাজসুখ বিলাস ব্যসনের সাথে পরিচিত ছিলেন তা পরিত্যাগ করে সরল পবিত্র জীবনযাত্রা অবলম্বন করলেন। তিনি সকল প্রতিবেশী দেশের রাজাদের কাছে দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তিনি তাদের সাথে মৈত্রী ও প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। সকলে যেন নির্ভয়ে আপন রাজ্য শাসন করেন। এমনকি সম্রাট অশোক তার উত্তরাধিকারীদের কাছেও দেশ জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, প্রেম করুণা সহৃদয়তার মধ্যে দিয়েই মানুষের মনকে জয় করার। এই জয়কে সম্রাট অশোক বলতেন ধর্ম বিজয়। অশোক বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রধানত তারই প্রচেষ্টায় পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য শুধু যে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারকদের পাঠাতেন তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্তম্ভ পর্বত শিলাখণ্ডের ওপর বিভিন্ন উপদেশ উৎকীর্ণ করে দিতেন যাতে সেই অনুশাসন পাঠ করে প্রজারা তা পালন করতে পারে। সম্রাট অশোক হয়ে ওঠেন মৈত্রী ও অহিংসার মূর্ত প্রতীক।তবে ধর্মপ্রচারে অধিক মনোযোগী হলেও তিনি রাজ্যশাসনের ব্যাপারে সামান্যতম দুর্বলতা দেখাননি। পিতা-পিতামহের মতো তিনিও ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক। সুবিশাল ছিল তার রাজ্যসীমা।
কলিঙ্গ জয়ের পরে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। সম্রাটের ধর্মান্তরের ফলে রাজপরিবারের চিরাচরিত প্রথা ও অনুষ্ঠানে দেখা দেয় নানা পরিবর্তন। তিনি সমস্ত রাজ্যে পশুহত্যা বা পশু শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনিই প্রথম পশুদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন।সম্রাট অশোকের সময় ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হয় । এই সমস্ত পথের দু’পাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ রোপন করা হয় । যাতে মানুষ ছায়ায় পথ চলতে পারে। ক্ষুধার সময় গাছের ফল খেতে পারে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর পথের ধারে কূপ খনন করা হয়েছিল। শুধু মানুষ নয়, পশুদের প্রতিও ছিল তার গভীর মমতা। সর্বজীবের প্রতি করুণায় এমন দৃষ্টান্ত জগতে বিরল। এই নতুন ধর্ম প্রচারে তিনি প্রাণিহত্যা না করা ও জীবিত প্রাণির ক্ষতি না করার নীতি গ্রহন করেন এবং পাথরের স্তম্ভের ওপর ধর্মীয় বাণী খোদাই করে প্রচার করার আদেশ দেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং পর্বত গ্রাত্রে, স্তম্ভে, শিলালিপিতে বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ করে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসার সাধন করেছিলেন । সম্রাট অশোকের শীলালিপি গুলো পর্বত গ্রাত্রে, স্তম্ভের উপর এবং গুহার অভ্যন্তরে পাওয়া যায় । তাই এগুলোকে যথাক্রমে শিলালিপি, স্তম্ভলিপি এবং গুহালিপি বলা হয়।উনিশ শতকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে পাথরের স্তম্ভের ওপর অশোকলেখ আবিস্কৃত হয়। ১৮৩৭ সালে কলকাতা ঠাকশালের কর্মচারী এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত জেমস্ প্রিনসেপ সর্বপ্রথম অশোকের শীলালিপির পাঠোদ্বার করেন।তবে ভারতের ইতিহাসে অশোকই প্রথম সম্রাট যিনি তাঁর আর্দশ এবং কৃতিত্ব এভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।তবে, সম্রাট অশোক নিজে বৌদ্ধ হলেও অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। তাঁর আদেশে রাজ্যের সকলেই যে যার ধর্ম পালন করত। একটি শিলালিপিতে তিনি লিখেছেন, নিজের ধর্মের প্রতি প্রশংসা অন্যের ধর্মের নিন্দা করা উচিত নয়। পরস্পরের ধর্মমত শুনে তার সারবস্তু ও মূল সত্যকে গ্রহণ করা উচিত।বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংহতি স্থাপনের জন্য এবং বৌদ্ধ সংঘসমূহের ভিতরে আন্তসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে পাটালিপুত্র নগরে তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন এর আয়োজন করেন । বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্য তিনি রাজপুত্র মহেন্দ্রকে সিংহল দ্বীপেও পাঠিয়েছিলেন।
আনুমানিক ৪০/৪২ বছর রাজত্ব করার পরে সম্রাট অশোক দেহত্যাগ করেন। আর তাঁর মৃত্যুর অল্পকাল পরেই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
-তথ্য ও ছবি সংগৃহীত লেখা সুস্মিতা বিশ্বাস